Search This Blog

Friday 2 February 2018

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাবার অনেকগুলো রাস্তা

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাবার অনেকগুলো রাস্তা। মানে তুমি যদি গাড়ি নিয়ে যাও তাহলে বাগডোগরা ছাড়িয়ে অনেকদূর পর্যন্ত টয়ট্রেন লাইনের সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে ঝপ করে রোহিনীর নতুন হাইরোডের মত রাস্তা দিয়ে ন্যাড়া পাহাড় পেরিয়ে কার্সিয়াং পৌঁছে যাবে।

কার্সিয়াং ট্যুরিস্ট লজে সেই যে মোমো আর কফি খেয়ে গাড়ি স্টার্ট দেবে তারপরেই একা একা গাড়ির স্টিরিওতে কিশোরকুমার গেয়ে উঠবে, মেরে সপনো কি রানী কব...। আর তুমি আঙুলের সিগারেটটা শেষবারের মত টেনে কাঁচ উঠিয়ে দেবে। আহ্ ঠান্ডা...
     আস্তে আস্তে টুং সোনাদা ঘুম পেরিয়ে যেতে যেতে স্টিরিওর কিশোরকুমার অঞ্জন দত্তর গলায় গেয়ে উঠবে,
        জানলার কাঁচে ঠোঁট চেপে
        ছবি এঁকেছি নিশ্বাসের
        পাহাড় আঁকা কত সোজা
        হারিয়ে গ্যাছে সেই ড্রয়িং খাতা।

     অথবা তুমি যেতে পারো সুকনার জঙ্গল আর সেনাছাউনি পেরিয়ে, চা বাগানের পেটের মধ্যে দিয়ে কমলালেবুর গন্ধ নিতে নিতে যে রাস্তাটা মিরিক সুখিয়াপোখরি হয়ে লেপচাজগতের পাশ দিয়ে ঘুমে গিয়ে উঠেছে, সেটা দিয়ে। পাইন কুয়াশা আলোছায়া নিয়ে ২৪ রিলের সিনেমা। তবে বোর তুমি হবে না এটুকু বলতে পারি। জোড়পোখরির উঁচুতে তুমি যখন গাড়িটা থামাবে, তুষার চেঁচিয়ে উঠবে, ওই দ্যাখ সান্দাকফু যাবার রাস্তা। ওই তো চিত্রের সেই চোর্তেন।
     ঘুম পৌঁছতে পৌঁছতে গাড়ির অনেকেই ঘুমিয়ে পড়বে। এই রাস্তাতেই কিন্তু আসলে অঞ্জন দত্তের সাথে তোমার দেখা হবে। বিজনবাড়ির রাস্তাটা যেখানে বাঁদিকে নিচে নেমে গেছে সেই রাস্তা ধরে গীটার কাঁধে উঠে আসবে অঞ্জন, সামনে অল্প ঝুঁকে। গাড়ির ঘুমন্ত মানুষগুলো কেউ জানতেই পারবে না তুমি ভাললাগায় মরে যেতে যেতে অ্যাক্সিলারেট করতে করতে কিভাবে লাডেন-লা রোড পেরিয়ে কেভেন্টার্সের সামনে হাজির হলে।

     আর একটা উপায় সেভক রোড ধরা। মহানন্দার জঙ্গলের বুকচেরা কালো অ্যাসফাল্ট চটচট করতে করতে তুমি হুমড়ি খেয়ে পড়বে তিস্তার কাছে গিয়ে। এ রাস্তায় অনেক প্রলোভন। করোনেশন ব্রীজের কাছে পৌঁছলে সামসিং এর বৃষ্টিভেজা বাংলো তোমায় হাতছানি দেবে। উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হবে। আর একটু এগোলে বাঁদিকের লাটপাঞ্চার পাহাড় থেকে ডাক পাঠাবে টুকাইয়ের নেচার স্টাডি ক্যাম্প। ফাঁদে পা দিলে চলবে না। রম্বি থেকে বাঁদিকে মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবীর বাংলোবাড়ি। এখনো তাজা রবি ঠাকুরের গায়ের গন্ধ।
     যাওয়া যাবেনা। তুমি তো ড্রাইভার। কোথায় যাবে ঠিক করার তুমি কে হে! তুমি শুধু ক্লাচ ব্রেক আর অ্যাক্সিলারেটর কনট্রোল করবে।
     তিস্তাবাজার গিয়ে পৌঁছলে তুমি সত্যিকারের ডিলেমায় পড়ে যাবে। তিস্তা পেরিয়ে কালিম্পংয়ে রবীন্দ্রনাথের গৌরীপুর হাউসের মলিনতার নীচেই ভোঁ'র বাড়ি। তোমরা অনেকে আসবে বলে পাশের বাড়ি থেকে অনেক লেপ কম্বল চেয়ে নিয়ে এসে এখন বাজারে গেছে। মাংসের দোকানদারকে বলে মুরগির ছাল ছাড়ানো মাংস কিনতে গেছে। তোমরা তো আবার ছালসহ মাংস খেতে পার না।
     নরম হওয়া চলবে না। আবেগ রাখা চলবে না। সোজা গাড়িটাকে চাকুর মত চালিয়ে দিতে হবে পেশক রোডের খাঁড়া অবাধ্যতায়। বড়জোর রঙ্গিত ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে তুমি ভোঁ'কে একটা মেসেজ পাঠাতে পার, তুই আমার পাহাড়ের পাশপোর্ট।
     খুব দ্রুত চোখটা মুছে নিয়ে আবার ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসতে হবে না! উইন্ডস্ক্রীনের মত তো চোখে কোন ওয়াইপার লাগানো থাকে না। আর ড্রাইভারকে অত মনখারাপবিলাসী হলে চলে না।
     পেশক টি গার্ডেনকে বাঁহাতে রেখে সাতমাইল লামাহাটা হয়ে জোড়বাংলার দিকে এগিয়ে চলে স্বপ্নের গাড়ি। এরাস্তাতেও ঘুম পড়ে। ঘুম আসার আগেই তুমি ছাড়া বাদবাকিরা ঘুমিয়ে পড়ে। তোমাকে তো জেগে থাকতেই হবে ওস্তাদ, তুমি যে স্বপ্নচালক।

     শেষ রাস্তাটা বেরঙীন। এই যতগুলো রাস্তায় তুমি এতক্ষণ গাড়ি চালালে সব সামনে দিয়ে তোমাকে দার্জিলিং নিয়ে যাবে। শেষ রাস্তাটা পেছন দিয়ে। সিকিমের জোরথাং এ সাসপেনশন ব্রীজে রঙ্গিত পেরিয়ে টাকভর টি এস্টেট, পাতলেবাসের জঙ্গল পেরিয়ে নর্থ পয়েন্টে সেন্ট যোসেফের পাশে লেবং কার্ট রোডে ঠেলে উঠবে। এই রাস্তায় আগে সিকিম থেকে লুকিয়ে মদ আসতো। তোমাকেও চোরাই মদবাহকের দ্রুততায় চালিয়ে পার হয়ে আসতে হবে এই নির্জন রাস্তা।

     যে রাস্তা দিয়েই যাও না কেন, দার্জিলিং তোমাকে পৌঁছে দেবেই। তুমি চাইলেও কোলাখাম কি কালুক পৌঁছতে পারবে না।
   All roads lead to Rome.

No comments:

Post a Comment