পুরো গল্প একসাথে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত।
#লেপের_তলায়_লেপচাজগৎ
#পর্ব_1
বিয়ের আগেই সুদীপ কে বলে দিয়েছিলাম আমার শাড়ি গয়না মেকআপ পার্লার এসব গিফ্ট লাগবে না। একটাই শর্ত - নিয়ম করে বছরে দুবার বেড়াতে নিয়ে যেতেই হবে। একবার অ্যানিভার্সারি তে - এটা মাস্ট। আর একবার যখন ইচ্ছা। তবে অ্যানিভার্সারির সময় টা কোন অজুহাতে ক্যান্সেল করা যাবে না। তা এই শর্ত টি সুদীপ শিরোধার্য করেই বিয়ে টা করে ফেলেছিল। তা সেই শর্ত এখনো পর্যন্ত পালন করে চলেছে। তা এবছর জানুয়ারিতে আমাদের তৃতীয় বর্ষের অ্যানিভার্সারির শর্ত পালন করতে বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই আমি তাড়া দিচ্ছিলাম আমার বহু দিনের ইচ্ছা লেপচাজগৎ এর ট্যুর প্ল্যান করার। গুতো দিয়ে দিয়ে নভেম্বরে দার্জিলিং মেলের পঁচিশে জানুয়ারির টিকিট টাও বুক করালাম। ক্যালেন্ডারে পর পর বেশ কয়েকটি ছুটি। প্ল্যান হলো পঁচিশে জানুয়ারি রাতে দার্জিলিং মেল ধরব। ছাব্বিশ ও সাতাশ লেপচাজগৎ থাকবো। আঠাশে দার্জিলিং থাকা। উনত্রিশে রাতে এনজেপি থেকে আবার দার্জিলিং মেল ধরে কলকাতা। দার্জিলিং আগে দুবার গেলেও কেভেনটার্স এ খাওয়ার লোভে রাজি হয়ে গেলাম।
এবার নেট ঘাটতে লাগলাম লেপচাজগৎ এ থাকার জন্য কোন হোম স্টে বুক করা যায়। অনেক ঘেটে ঘুঁটে চার টে হোম স্টে প্রাইমারিলি সিলেক্ট করলাম। wbfdc, salakha homestay, pakhrin homestay, kanchankannya homestay. । wbfdc এর লোকেশন টা আমার বড় পছন্দ হল। কিন্তু পরিচিত কিছু জনের কাছে শুনলাম মেনটেনেন্স নাকি একদম ভালো না। গিজার খারাপ। সুতরাং সুদীপ ওটা বাদে দিয়েই দিল। বাকি গুলো একটা আমার পছন্দ হয় তো আর একটা ওর পছন্দ হয়। শেষমেশ সুদীপ ই kanchankannya homestay বুক করে ফেললো। খাওয়া ও থাকা প্রতি জনের প্রতি দিন নশো টাকা। খাওয়ার মধ্যে থাকছে ব্রেকফাস্ট(ব্রেড বাটার/পুরি সব্জি), লাঞ্চ(ভাত, ডাল, আলু-ভাজা, সব্জি, চিকেন/ডিম), ইভনিং স্ন্যাক্স(আলু পকোড়া / পেঁয়াজী), ডিনার (ভাত/রুটি,ডাল,আলু-ভাজা, ডিম/চিকেন)। দুপুরে যদি চিকেন নেওয়া হয় তাহলে রাতে ডিম। আবার রাতে চিকেন নিলে দুপুরে ডিম। হোম স্টের ওনার প্রসাং জী কে ফোন করে কিছু অ্যাডভান্স ওনার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। যাক এবার নিশ্চিন্ত। দার্জিলিং এর রিসর্ট টা সুদীপ ই পছন্দ করে Go ibibo থেকে বুক করেছিল। Central nirvana resort ।
এই পর্যন্ত প্ল্যান ঠিকই ছিল। ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ একদিন হঠাৎ সুদীপ অফিস থেকে ফোন করে বলল ওর অফিসের দুজন কলিগ ও ওই পঁচিশে জানুয়ারি এনজেপির টিকিট কেটে রেখেছে। সুদীপের কাছে লেপচাজগৎ এর কথা শুনে ওরাও আমাদের সঙ্গী হতে চায়। ওরাও আমাদের মত হাসব্যান্ড ওয়াইফ যাবে। সুদীপ এর অফিস কলিগ সৌমেন দা আর দিবাকর দুজন কে আর তাদের ওয়াইফ ঐন্দ্রিলা দি ও মালিনী এদের ও আমি চিনি। সুতরাং সবাই মিলে ব্যাপার টা বেশ জমবে। আমাদের দুজনের ট্যুর না প্ল্যান এখন ছয় জনের প্ল্যান হয়ে গেছে। মুশকিল টা হলো আমার আর সুদীপ এর যাওয়া আসার টিকিট কনফার্ম। কিন্তু সৌমেন দাদের RAC। আর দিবাকরদের যাওয়ার টিকিট waiting list ।ফেরার টিকিট অবশ্য কনফার্ম। যাইহোক একটা সামান্য ট্রেন টিকিট আমাদের প্ল্যান বানচাল করতে পারবে না। তড়িঘড়ি ওদের ও kanchankannya homestay ও central nirvana তে ঘর বুক করা হলো।
#লেপের_তলায়_লেপচাজগৎ
#পর্ব_2
জানুয়ারি তে কলকাতাতেই যা ঠান্ডা পড়ল লেপচাজগৎ এ যে কি ঠান্ডা হবে সেই চিন্তা করে রোজ গুগলে লেপচাজগৎ এর টেম্পারেচার চেক করি। টেম্পারেচার দেখেই কলকাতায় বসে আমার হাঁড়ে ঠকাঠকি লেগে যায়। বাপ রে - রাতে নাকি মাইনাস তিন আর দিনে ম্যাক্সিমাম- চার। ওই দেখে অনলাইন এ একটু মোটা সোটা জ্যাকেট উলিকট ইনফার্নো অর্ডার করে দিলাম। সুদীপ বলে এসব নাকি লাগবে না। আমি ফালতু ফালতু এসব কিনছি। এই নিয়ে একদিন ধুন্ধুমার ঝগড়া ও হয়ে গেল। পরে অবশ্য টের পেয়েছিল কে ঠিক আর কে ভুল। দেখতে দেখতে যাওয়ার দিন চলে এল। আগের দিন রাতে ঝটপট প্যাকিং সেরে নিলাম। টেম্পারেচারের কথা মাথায় রেখে একটা ছোট ফ্লাস্ক, ছোট্ট ইলেকট্রিক ইমারশন, ইলেকট্রিক কেটল নিতে ভুললাম না। স্লীপার ক্লাসে টিকিট কাটা হয়েছে বলে দুটো পাতলা কম্বল ও ট্রলি তে ঠেসে দিলাম। সুদীপ তো এসব দেখে গজ গজ করতেই লাগল। কিন্তু ওসব কথা কানে নিতে নেই। ব্যস আপাতত প্যাকিং কমপ্লিট। পরের দিন রাত দশটায় আমাদের ট্রেন শিয়ালদহ থেকে। কিন্তু দিবাকর বা সৌমেন দা কারোর টিকিট ই কনফার্ম হয় নি। সৌমেন দাদের তাও RAC.। কিন্তু দিবাকরদের তো RAC ও হয় নি। waiting list এই আছে। দিবাকর আর মালিনী তো বলছিল যাওয়া ক্যান্সেল করবে। আমরাই জোরজার করে বললাম কোন অসুবিধা হবে না। আমাদের তো কনফার্ম টিকিট আছে। ওটাতেই একটা রাত শেয়ার করে কাটিয়ে দেব। তাও ওরা আমাদের অসুবিধার কথা ভেবে দোনা মোনা করতে থাকে। আমি এবার রেগে গিয়ে বললাম এত ফর্মালিটি করলে আর তোমাদের গিয়ে কাজ নেই। কলকাতা তেই বসে থাকো। শেষ পর্যন্ত ওরা রাজি হয়েই গেল। ঠিক হলো পরদিন শিয়ালদহ তে গিয়ে সবাই মিট করবো। সাড়ে ন’টা নাগাদ সবাই শিয়ালদহ তে চলে আসব।
পঁচিশে জানুয়ারি সকালে খবরের কাগজে দেখি পশ্চিমী ঝঞ্ঝার কারণে উত্তরবঙ্গে তাপমাত্রা আরও কমেছে আর কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গে তাপমাত্রা বেড়েছে। পড়েই গুগল এ লেপচাজগৎ এর টেম্পারেচার চেক করে তো চক্ষুচড়কগাছ। দিনের বেলা টেম্পারেচার দেখাচ্ছে মাইনাস দুই। বুঝলাম সব মিলিয়ে জমেই যাবে। আর ও একটু টুকটাক গোছানো সেরে নিয়ে ডিনার এর জন্য নতুন ছোট আলু আর কড়াইসুঁটির দম আর পরোটা বানিয়ে নিলাম। যাওয়ার সময় ও প্রায় চলে এল। হঠাৎ দেখি সুদীপ কোথা থেকে এক মস্ত প্যাকেট নিয়ে হাজির। সটান আমার হাতে ধরিয়েই আবার উধাও। মাঝে মাঝে এমন সব উদ্ভট কাজ করে যে বিরক্তি লেগে যায়। একে তো বেরোনোর মোটে আর এক ঘণ্টা বাকি এর মধ্যে কোথায় গেল কে জানে। যাক গে আমার অত ভাবার সময় নেই। প্যাকেটে কি আছে কে জানে। তাড়াতাড়ি খুলে দেখি খুব সুন্দর adidas এর একজোড়া লেডিস স্নিকার্স। আহা এরকম গিফট ভালোই লাগে। পরেও দেখলাম সাইজ টাও একদম পারফেক্ট। মন টা বেশ উৎফুল্ল হয়ে গেল। খানিক পরেই অবশ্য সুদীপ চলে এল। আমি আবার তখন ওই জুতো পরে ঘরের মধ্যে অনেক রকম হরকত করে চলেছি। দেখেই বুঝেছে আমার জুতো টা বেশ পছন্দ হয়েছে।নাহ আর দেরি করা চলবে না। ঘড়ির কাঁটা বলছে এবার দুগ্গা দুগ্গা বলে বেড়িয়ে পড়তে।
শিয়ালদহ পৌঁছে দেখি সবাই এসে হাজির। বোর্ডে দেখি 9B প্ল্যাটফর্মে দার্জিলিং মেল দিয়ে দিয়েছে। সবই তো ঠিক আছে। কিন্তু মালিনী টেনশন করতে করতে প্রায় টুনটুনি পাখি হয়ে গেছে। ওদের টিকিট RAC ও হয় নি। সুদীপ দিবাকর কে গিয়ে বলল ওদের দুটো জেনারেল টিকিট কেটে আনতে। আর আমাদের তো কনফার্ম টিকিট। ওটা শেয়ার করলে টিটি কিছু বলবে না। যাইহোক এরপর ঠাকুর ঠাকুর করতে করতে S9 খুঁজতে লাগলাম। সৌমেনদা দের আবার S5। ওরা তাই এগিয়ে গেল। একেবারে এনজেপি পৌঁছে ওদের সাথে দেখা হবে। সবাই দার্জিলিং মেলে চড়ে বসলো। এই দার্জিলিং মেল নাম টার সাথে যেন সবার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেই কোন ছোট্ট বেলায় বাবা মার সাথে এই ট্রেনে আমার প্রথম রাত কাটানো। একটা বার্থে মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়াতো। বাবা উপরের বার্থে শুলে নিচের বার্থ থেকে আমি বাবার হাতের আঙুল ছুঁতাম বারবার। তখন হয়তো খেলা ছিল। এখন সেই খেলা গুলো যেন মনের মধ্যে একটা জীবন্ত চলচ্চিত্রের অংশ। রাত বাড়লে হকার দের সেই 'চায় গরম চায়', 'চা কফি চা' এই আওয়াজ গুলো না শুনলে মনেই হতো না বেড়াতে যাচ্ছি। ওই আওয়াজ শুনতে শুনতে আর ট্রেনের দুলুনিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম। অনেক রাতে যখন ফরাক্কা ব্যারেজের উপর দিয়ে ঝমঝমিয়ে ট্রেন টা যেত বাবা ডাকত। বাবার সাথে ট্রেনের জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে বিশাল ব্যারেজ টা দেখতাম। মাঝে মাঝে ভয় হতো যদি ট্রেন টা পড়ে যায়। বাবা কে বলতেই বলত দুর বোকা আমি তো আছি। তাতেই মনের সব ভয় ফুৎ করে উড়ে যেত। এখন হয়তোবা বেড়াতে যাওয়ার মজা গুলো অন্যরকম কিন্তু এই স্মৃতি গুলো যদি সেই মজার সাথে মিশে যায় তবে তার থেকে ভালো আর কিছু হতে পারে না। এখনও ফরাক্কা ব্যারেজের উপর দিয়ে যখনই গেছি সুদীপ আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে একসাথে দেখি। এখনও ঝমঝম আওয়াজ এর সাথে বাবার বলা কথা গুলো কানে বাজে। এখন তো আর ও এক জন যোগ হয়েছে। সুদীপ আর বাবা মা থাকতে আমার সত্যিই কোন ভয় নেই।
আমার এইসব নস্টালজিক ভাবনার মাঝে টিটি এসে হাজির। ভদ্রলোক সত্যিই খুব ভালো। কোন অসুবিধা হয়নি। এক্সট্রা যে টাকা লেগেছিল মালিনী দের তার জন্য চালান ও দিয়েছিলেন। মালিনী তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু তারপর ডিনার করে এমন ঘুম দিল যে দিবাকর বেচারা সারা রাত প্রায় বসেই কাটালো। আমি আর সুদীপ পালা করে করে ঘুমিয়ে নিলাম। রাত বাড়তে ঠান্ডা টা টের পেয়ে সুদীপ কিন্তু নিজেই কম্বল বের করে গায় দিয়েছিল। পরদিন সকালে আটটায় এনজেপি পৌঁছানোর টাইম। মোটামুটি ঠিক সময়েই পৌঁছল। আমাদের লেপচাজগৎ এর হোম স্টে তে গাড়ির জন্য বলা ছিল।এনজেপি থেকে লেপচাজগৎ টাটা সুমন তে 2300 টাকা। এনজেপি নেমে ড্রাইভারজী কে ফোন করতে জানালেন উনি অনেক আগেই চলে এসেছেন। গাড়ির মাথায় এরপর ঝটপট লাগেজ তুলে বেঁধে ফেলা হলো। সকালের হাওয়ায় বেশ ঠান্ডা লাগছে। ব্যাগ থেকে টুপি মাফলার সব বেড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভারজী জানালেন আমাদের লেপচাজগৎ পৌঁছতে তিন ঘন্টা মতো লাগবে। রাস্তা তে ব্রেকফাস্ট করে নেব ঠিক হলো। উঠে বসলাম ছয় মুর্তি গাড়ি তে। দিবাকর কিন্তু ঘুমে ঢলছে।
#লেপের_তলায়_লেপচাজগৎ
#পর্ব_3
এনজেপি থেকে রোহিণী রোড ধরে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল। সেই চির পরিচিত শাল সেগুনের জঙ্গল রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে যেন ছোটবেলায় এনজেপি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার এক হারিয়ে যাওয়া অ্যালবাম দেখাচ্ছে। শীতের শুকনো বাতাস ঝরে পড়া অজস্র শুকনো পাতার নুপুর বাজিয়ে এক অজানা দিকশূন্যপুরে নিয়ে যায়। এই জঙ্গল টা দেখলেই আমার মনে হয় একা একা এই জঙ্গলে হারিয়ে যাই। শুকনো ঝরা পাতার শব্দ আমার মনে নেশা লাগিয়ে দেয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীললোহিত হলে হয়তো হারিয়েই যেতাম। কিন্তু সে যখন হওয়ার নয় অগত্যা 'কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে'। রাস্তার দু’ধারে শীতের বৈরাগ্য মেখে গাছ পালা দিগন্ত বিস্তৃত গেরুয়া চাদর গায়ে জড়িয়ে আছে। শুষ্ক দিগন্তের ক্যানভাসে মাঝে মাঝে পলাশ শিমুলের রক্ত রাঙা ছোঁওয়া। বনতুলসী আর অজানা ছোট্ট ছোট্ট ফুলের রঙে ক্যানভাস যেন মনের ছবি। গাড়ির মধ্যে তখন ওদের জমাটি আসর। সৌমেন দা আর ঐন্দ্রিলা দির খুনসুটি ঝগড়ায় আমাদের হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা। এদিকে আবার মালিনী খিদে সহ্য করতে পারে না। গাড়ি তে ওঠা থেকে বলেই চলেছে। ড্রাইভারজী কেও পনেরো মিনিট পর পর বলছে ব্রেকফাস্ট এর জন্য গাড়ি থামাতে। দিবাকর ও এই সুযোগে মালিনীর লেগপুলিং করতে ছাড়ছে না। অবশেষে ড্রাইভারজী ব্রেকফাস্ট এর জন্য গাড়ি দাঁড় করালো। একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট। সামনে দাঁড়ালেই চোখ জুড়ানো ঢালু পাহাড় রোদ মেখে দাঁড়িয়ে। ঠান্ডা হাওয়া টা বেশ গায়ে লাগছে।খিদে টাও চনচনে হয়ে উঠেছে। ব্রেকফাস্টে সুদীপ মালিনী পুরি সব্জি, সৌমেন দারা রুটি আর আমি আর দিবাকর ওয়াই ওয়াই অর্ডার দিলাম। খিদের মুখে আর ঠান্ডাতে গরম গরম খাবার পেয়েই সেগুলো সদ্ব্যবহারে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পেট ভরতে আবার যাত্রা শুরু। গাড়ি এবার পাহাড়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। হেয়ার পিন বেন্ড গুলো দেখলেই মনে হয় যেন এই বাঁক টা ঘুরলেই অন্য একটা জগত যেন এক্ষুনি চোখের সামনে চলে আসবে। আর সত্যিই তাই প্রতিবার যেন আলো আঁধারি রোদ ছায়ায় আবৃত হয়ে পাহাড় যেন নতুন রূপে শুধু আমার চোখে আলাদা করে ধরা দেয়।আরও খানিক চড়াই ভাঙ্গার পর গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে একরাশ ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পড়ে আমাদের জড়িয়ে ধরল।রুক্ষ ক্যানভাস পার করে রোদ কুয়াশা মাখা চিরহরিৎ পাইন বনের পটভূমিতে প্রকৃতির লাবণ্যে আমরা মুগ্ধ। কত যুগ যুগ ধরে যেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো কুয়াশায় অবগুণ্ঠিতা প্রকৃতিকে পাইন বন দৃঢ় পাহারায় পৃথিবীর সমস্ত কৃত্রিমতা থেকে রক্ষা করে চলেছে। দীর্ঘ দিনের ঝরে পড়া পাতা ঘন কুয়াশায় ভিজে ভিজে অজানা অচেনা বুনো ফুলের সুগন্ধ মিশে যেন পৃথিবীর অন্তস্থল থেকে আদিম গন্ধ তুলে এনে মিশিয়ে দিচ্ছে ভেজা বাতাসে। আর সেই মাতাল করা গন্ধ মেখে প্রকৃতি যেন কুয়াশার পর্দা টেনে রহস্যাবৃতা। এই বনের কোনখানে যেন রহস্য ঘেরা প্রাচীন রাজপুরীর এক ঘরে সোনার কাঠি রূপোর কাঠির যাদু স্পর্শে এই রহস্যময় মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কখনো সোনা ঝলমলে রোদ, কখনো বা ঘন কুয়াশার অন্ধকার গায়ে মেখে আমরা এগোতে থাকলাম। দেখতে দেখতে এসে পড়লাম কার্শিয়াং। মনে পড়লো প্রথম দার্জিলিং এসেছিলাম যখন এই কার্শিয়াং এর উপর দিয়ে টয়ট্রেনে চেপে গেছিলাম বাবার কোলে চেপে। বাবাই তখন বলেছিল, কার্শিয়াং এর আর এক নাম নাকি land of white Orchid। তা অর্কিডের দেখা না পেলেও স্কুল টাইমে রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া লাল ইউনিফর্ম পরা ছোট্ট ছোট্ট লাল গালের অনেক ফুলের দেখা পেলাম। এদের নিষ্পাপ মুখের সৌন্দর্যের কাছে পৃথিবীর যে কোন দামি অর্কিড ম্লান। সৌমেন দা তো দেখলেই ওদের ফটো তুলছে। আর মালিনী আবার পাহাড়ী লোমশ কুকুর দেখলেই এমন লাফালাফি করছে যে ওদের কে বিস্কুট খাওয়ানোর জন্য গাড়ি থামাতেই হলো। গাড়ি থেকে নামতেই কিন্তু ঠান্ডা হাওয়া আমাদের মোটা জ্যাকেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে একেবারে হাঁড় পর্যন্ত ছুঁয়ে দিল। গাড়ি এবার ঘুম হয়ে লেপচাজগৎ যাবে। পথ আর বেশি বাকি নেই। ঘড়িতে সবে দুপুর সাড়ে বারোটা, কিন্তু এর মধ্যেই এখানে ঘন কুয়াশা আর শীতে যেন ঝুপ করে বিকেল নেমে এসেছে।
দেখতে দেখতে লেপচাজগৎ পৌঁছে গেলাম। ছোট্ট একটা ছবির মতো গ্রাম গুটি কয়েক হোমস্টে নিয়ে পাহাড়ের কোলে বসে আছে। পাশাপাশি ই সব কটা হোম স্টে। দোকান পাট, এ টি এম এসব যান্ত্রিক আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে এ মুক্ত। শুধু পাইন, পাহাড়, রোদ, কুয়াশা, পাখির কলকাকলিতে এ পূর্ণ। গাড়ি থেকে নামতেই কিন্তু আমাদের ওরে বাবা রে মা রে অবস্থা। হাতের আঙুল গুলো যেন কেউ বরফের ছুরি দিয়ে কেটে নেওয়ার চেষ্টা করছে। নাকের ডগা টাও যেন কে কুচুৎ করে কামড়ে ধরল। মালিনী তো একেই শীত কাতুরে তার উপর এই ঠান্ডাতে তো তিড়িং বিড়িং শুরু করে দিয়েছে। সবার ই মোটামুটি এই ঠান্ডা তে এক ই অবস্থা। থাকবো কি করে এই ঠান্ডায়!!! সৌমেন দার কিন্তু দারুণ এনার্জি, ঐ ঠান্ডা তেই ফটো তুলতে লেগেছে। যদিও আঙুল গুলো কিন্তু অবশ হয়ে গেছে ঠান্ডা তে। তাড়াতাড়ি লাগেজ নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। পরিচ্ছন্ন কাঠের ঘর। বেশ পরিষ্কার। বেডে দেখলাম এই মোটা মোটা তিন টে ডাবল কম্বল। দেখেই বুঝলাম দুপুর একটা নাগাদ যদি এই ঠান্ডা হয় তো রাতে যে কি হবে!!! ঘরে দুটো অসুবিধা, এক - কোন ঘরে রুম হিটার নেই। আরও একটা অসুবিধা হলো আমাদের নেওয়া তিনটে ঘরের মধ্যে দুটো ঘরে গিজার নেই। অবশ্য জল গরম চাইলে সঙ্গে সঙ্গে বালতি করে জল দিয়ে যাবে বলেছে। দুপুরের খাবার এর অর্ডার দিয়ে হাত মুখ ধুতে বেসিনের কল খুলে জলে হাত দিতেই যেন কারেন্টের শক লাগলো। আমার তখন যেন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। একটু পরে অবশ্য গরম জল দিয়ে গেল। হাতের আঙ্গুল এমন ই অবশ যে জলে হাত দিয়ে বুঝতেই পারছি না আদৌ গরম না ঠান্ডা। ঝুপঝাপ করে সবাই যা হোক করে স্নান করে তো নিলাম কিন্তু ওরে বাবারে।! তার পরে তো ম্যালেরিয়ার কাঁপুনি শুরু হলো। ইনফার্নো, মোটা সোয়েটার, তার উপর মোটা জ্যাকেট সব কিছু ডাহা ফেল। পায়ের কথা তো ছেড়েই দিলাম,. দুটো মোজা কেডস পরেও পা এ কোন সাড় নেই।। মুখে ভালো করে ক্রিম ঘসতেই হবে, এর মধ্যেই ফাটতে শুরু করেছে। এর মধ্যেই দুপুরে লাঞ্চ এর ডাক পড়ল। কুয়াশায় ততক্ষণে চারদিক ঢেকে গেছে। জ্যাকেটের পকেট থেকে হাত বার করতেই ভয় লাগছে তো খাব কি করে। ঐন্দ্রিলা দি আমাদের তাড়া দিয়ে খেতে বসালো।। টেবিলের উপর বড়ো বড়ো হটপট বন্দি ধোঁয়া ওঠা সব খাবার, জগ ভর্তি গরম খাবার জল,পরিষ্কার প্লেট সব রাখা। শুধু নিজেরা সার্ভ করে নিতে হবে। ঐন্দ্রিলা দিই দুঃসাহসিক ভাবে গ্লাভস হাত থেকে খুলে আমাদের সার্ভ করতে লাগল। আর আমরা পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঠুঁটো হয়ে বসে থাকলাম। ভাতের মধ্যে ধোঁয়া ওঠা গরম ডাল দিতেই সুদীপ বললো ওই গরমে তাড়াতাড়ি হাত দিতে, তাতে হাতে একটু আরাম লাগবে। বলা মাত্রই কাজ। আর শুধু তাই না খিদের মুখে ওরকম গরম সুস্বাদু রান্না পেয়ে দেখতে দেখতে এক-দু প্লেট ভাত উড়ে গেল। খাওয়া দাওয়া তো হলো। এবার কি করি। বাইরে ঘরে সব জায়গায় হি হি করা হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডা। কম্বল গুলো তে মনে হচ্ছে কে যেন বরফ দিয়ে রেখেছে। বিছানা গুলো ও যেন জলে ভেজা। বাইরে যে যাব তা যা কুয়াশায় অন্ধকার হয়ে আছে যে যাওয়ার মতো নেই। সৌমেন দা কিন্তু ফটো তোলার নেশায় বাইরে যাওয়ার জন্য সবাইকে বলছে। না বাবা আমি আর পারছি না। আমি ততক্ষণে ওই বরফ ঠান্ডা কম্বলের তলায় ঢুকে ঠ্কঠক করে কাঁপছি। মালিনী ও সোজা কম্বলের তলায়। সুদীপ ও যাব কি যাব না করতে করতে থেকেই গেল। সৌমেন দা, ঐন্দ্রিলা দি আর দিবাকর কুয়াশার মাঝে একটু পরেই হারিয়ে গেল। কিছুতেই কিন্তু কম্বলের ভিতরে গরম হচ্ছে না। এই সময় হোম স্টের ওনার প্রসাং জী এসে আমাদের সাথে দেখা করলেন। এত আন্তরিক ব্যবহার, কোন কৃত্রিমতা নেই এতে কম্বল উষ্ণ না হলেও আমাদের মনে উষ্ণ ছোঁয়া লাগল। আমরা বললাম সন্ধ্যা তে একটু ক্যাম্পফায়ার এর ব্যবস্থা করতে, কিন্তু উনি বললেন আজ যা ড্যাম্প ওয়েদার তাতে আগুন ঠিক মতো জ্বলবে না। আগামীকাল ছাদে ব্যবস্থা করবেন। আজ আমাদের রুমের ব্যালকনিতে ছোট করে আগুনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবেন। কথা বলতে বলতে সৌমেন দারা আর তার সাথে সাথে গরম গরম প্লেট ভর্তি পেঁয়াজী আর চা হাজির। এখানের জলে খিদেও পাচ্ছে। সবাই মিলে টপাটপ পকোড়া মুখে পুড়তে লাগলাম। গরম চা এর সাথে বেশ জমে গেল।ততক্ষণে আমাদের ঘর সংলগ্ন কাঁচ ঘেরা ব্যালকনিতে প্রসাং জী আগুনের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। একটু গরম হওয়ার আশায় সবাই সে দিকে দৌড়ালাম। আহা আগুনের তাপ এই হাঁড় হিম করা ঠান্ডার মধ্যে যেন উষ্ণ আদরের মতো। ওখানেই আমাদের আড্ডা জমে গেল। কিন্তু আগুন কিন্তু বেশিক্ষণ জ্বালানো গেল না, বদ্ধ জায়গায় বড্ড ধোঁয়া তে চোখ জ্বলতে লাগল। তাই এইটুকু সময়ের মধ্যে পাওয়া উষ্ণ ছোঁয়া কে গায়ে জড়িয়ে ঘরে বসে আসর জমালাম আমরা। হঠাৎ জানলার পর্দা সরাতে গিয়ে দেখি দুর পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য উজ্জ্বল নক্ষত্র জ্বলা দার্জিলিং। হঠাৎ যেন ছোট বেলার ফেলে আসা একখান ছবি ভেসে উঠল। দার্জিলিঙের হোটেলের জানলা দিয়ে এরকম জোনাকি জ্বলা পাহাড়ের ঢাল প্রথম বার দেখে বাবা কে জড়িয়ে ধরে বলে উঠেছিলাম আচ্ছা বাবা আকাশ টা এরকম নিচে নেমে এল কি করে? আকাশ টা কি উল্টে গেল? বাবা শুনে খুব হেসে বুঝিয়ে বলেছিল-রাতের অন্ধকারে পাহাড়ের কোলের বাড়ির আলো গুলোই দুর থেকে ওরকম তারার মতো লাগে। অবাক হয়ে অনেক্ষণ সেই জানলা দিয়ে তখন তাকিয়েছিলাম। আমার হাতের কাছে ও যে এরকম একটা আকাশ পাওয়া যাবে জানতাম না যে। আজ ও এত দিন পর সেই একই দৃশ্য যেন একই রকম অমলিন। বাইরে কিন্তু নিবিড় ঘন কালো অন্ধকার। মাঝে মাঝে শুধু কিছু গাড়ি ঘন অন্ধকার আর গাঢ় কুয়াশা ভেদ করে যেন অন্য কোন গ্রহ থেকে এখানে হঠাৎ চলে এসেছে। কুয়াশার মাঝে তাদের জ্বলা চোখ গুলো কেমন ঘোলাটে রহস্যময় লাগছে। ঘড়িতে তখন সবে সাতটা। এর ই মধ্যে কেমন গভীর রাতের নিস্তব্ধতা। তবে কিছু সময় পরেই হঠাৎ পাশের কোন হোম স্টে থেকে উদ্দাম হিন্দি গানের সুর আর হল্লার আওয়াজ ভেসে এলো। এই নৈসর্গিক নিস্তব্ধতার সৌন্দর্যের মাঝে সেই শব্দ যেন যেন ফুটন্ত গরলের মতো আমাদের কানে এসে লাগছে। বাইরে বেরিয়ে প্রসাং জী কে দেখে সে কথা বলতে উনি বললেন যে ট্যুরিস্টরা এসে নাকি এরকম ব্যবস্থা করে দিতে বলে। আমাদের কেউই কিন্তু একটা কথা বুঝলাম না যদি এরকম নাচ গান উদ্দাম আওয়াজ চাই তাহলে এরকম শান্ত আদিম অকৃত্রিম প্রকৃতির শান্তির বিঘ্ন ঘটিয়ে কি লাভ। মানুষ ই যে প্রকৃতির বড় শত্রু সে যেন আবার চোখের সামনে দেখতে পেলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমাদের আড্ডার আসর টা ও ভেঙে গেল এরপর। বারান্দায় আমি একা দাঁড়াতে ঐ উৎকট আওয়াজের সাথে যেন মনে হলো এই অবগুণ্ঠিতা ভার্জিন প্রকৃতির কষ্টের আওয়াজ মিশে আছে। মনে মনে ভগবান কে বললাম এই কৃত্রিমতা থেকে এই যন্ত্রণা থেকে তোমার সৃষ্টি কে রক্ষা করো। না হলে এই আওয়াজে যে প্রকৃতির সযত্ন সৃষ্টির ধ্বংসের ভেরীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। খানিক পরেই খাওয়ার ডাক এলো। সন্ধ্যে তে এতো পকোড়া খেয়েছি যে আমি বেশি খেতে পারলাম না। আমি উঠে বাইরে আসতে দেখি আকাশে চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে। আর সেই আলোয় দেখি লেপচাজগৎ মোটা কুয়াশার লেপের তলায় মুড়ি দিয়েছে। তবে যা ঠান্ডা তাতে পেটের ভেতরে হাত পা সেঁদিয়ে যাওয়ার অবস্থা। তাড়াতাড়ি সবাই ঘরে ঢুকে কম্বলের তলায় ঢুকলাম। কিন্তু ওই ঠান্ডা বিছানায় ঠান্ডা কম্বল গায় দেওয়া যেন শাস্তি। তবে পরিবেশের ঠান্ডার সাথে আমাদের শরীর ও আস্তে আস্তে মানিয়ে নেওয়া শুরু করেছে। তবে হাতের আঙ্গুল আর পা সেই যে সকালে গাড়ি থেকে নামার পর ঠান্ডা কামড়ে ধরে অবশ করে দিয়েছিল এখনও তার অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। এতটাই অবশ পা এর আঙ্গুল গুলো যে হাঁটতে আঙ্গুলে ব্যথা লাগছে। গতকালের রাতে ট্রেনে আধঘুম আর সারাদিনের জার্নিতে শরীর ও অবসন্ন। সবাই এবার ঘুমের তোড়জোড় শুরু করেছে। প্রসাং জী বলে গেলেন আগামীকাল যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে তো ভোর বেলায় উনি আমাদের ডেকে তুলে নিজেই ভিউ পয়েন্টে নিয়ে যাবেন। ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কার দেখা যাবে। আমরাও আশ্বস্ত হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। অত ঠান্ডা বিছানা কম্বলে ঘুমোনো বেশ মুশকিল। তবে সারাদিনের কষ্টে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লাম।পরদিন সকালে প্রসাং জীর ডাকে ঘুম ভাঙলো। ঘড়ি তে দেখি সকাল ছ’টা। ঘরের জানালার কাঁচের শার্শি পার করে সূর্যের নরম আলো বিছানায় এসে পড়েছে। বাইরে বেরিয়ে ব্যালকনি দিয়ে দেখি ঝকঝকে নীল আকাশের মাঝে এককালে বরফ জমানো কুলফি আবার মাথায় যেন কেউ অল্প স্ট্রবেরি সিরাপ ঢেলে দিয়েছে।ঠিক যেমন ময়দানে বরফ জমানো লাঠির মাথায় পছন্দের রঙিন সিরাপ ঢেলে দেয়। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ সুদীপ দেখি সবাই কে ডেকে বলছে তাড়াতাড়ি বেরোতে, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। ওমা দেখো কান্ড এতক্ষণ ঘুম চোখে কি না কাঞ্চনজঙ্ঘা কে কুলফি আইসক্রিম ভাবছি!!! তবে সে দৃশ্য চোখের পলকেই মিলিয়ে গেল। ঘর থেকে ক্যামেরা নিয়ে আসতে আসতেই দেখি সুন্দরী মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছেন। মনের ক্যানভাসেই থাক সে ছবি। এই সময় হঠাৎ দেখি এক অন্য দৃশ্য। রাস্তার পাশের ঘাস আর গাড়ির মাথায় কে যেন ক্রিস্টালের গুঁড়ো বিছিয়ে দিয়ে গেছে। রোদ পড়ে ঝকঝক করছে। প্রসাং জী আমার অবাক হয়ে যাওয়া দেখে বললেন রাতে মাইনাস টেম্পারেচরে শিশির বরফ হয়ে জমে গেছে। ওমা এ বুঝি বরফ!! আমি আনন্দে এমন চিৎকার করলাম যে সবাই জড়ো হয়ে গেছে। সৌমেন দা তো ক্যামেরা নিয়ে সোজা নীচে। আমরাও পিছন পিছন ছুটলাম। চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে সবাই ঠান্ডা ভুলে গেছে। শুধু হাত পা গুলো অসাড়। একটুক্ষনের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে প্রসাং জীর সাথে চললাম ভিউ পয়েন্টের দিকে। মালিনী ঠান্ডায় এতই কাহিল যে ও আর গেলো না। ওকে বললাম আমরা একটু পরেই আসছি। ও যেন ততক্ষণে ব্রেকফাস্ট বলে দেয়। রাস্তার পাশেই পাইন বনের মধ্যে দিয়ে পা এ হাঁটা রাস্তা উপরে উঠে গেছে। ঝকঝকে রোদ চোরের মত পাতার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে আলো আঁধারির জাল তৈরী করেছে। রাস্তা বেশ চড়াই। দু মিনিটেই হাঁপিয়ে যেতে হয়। আমাদের মধ্যে তো রীতিমতো কম্পিটিশন লেগে গেল কে আগে যাবে। সুদীপ তো ক্রমাগত আমার লেগপুল করে চলেছে এই তুমি সান্দাকফু ট্রেকিং করতে যাবে? আমি ও ছাড়ার পাত্রী নই। বেশ তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। শুধু সৌমেন দা মন দিয়ে ফটো তুলছে। চলার রাস্তায় ঘাসে পাতায় বরফের পাতলা চাদর। পা পড়লে পিছলে যাচ্ছে। সুদীপ তো একবার ভালোই পিছলালো। একটু সময়ের মধ্যেই একটা বেশ উঁচু জায়গায় চলে এলাম। এটাই ভিউ পয়েন্ট। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা জায়গা। চোখ চলে গেল শ্বেত শুভ্র উন্নত শিখরে। নীল ক্যানভাসে স্বচ্ছ সাদা রঙে আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘা। হঠাৎ ফেলুদার সঙ্গী লালমোহন বাবুর বলা সেই দুখানা লাইন মনে পড়ে গেল - 'অয়ি কাঞ্চনজঙ্ঘে । দেখেছি তোমার রূপ উত্তরবঙ্গে'। সত্যিই তাই। উত্তরবঙ্গের এত জায়গা থেকে এত রকম ভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা কে দেখেছি, তাও তাকে যতবারই দেখি সেই উত্তেজনা একফোঁটাও কমে না। শুভ্র মুক্তোর গুঁড়োর রংয়ে আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘা কিন্তু তখন আর কাঞ্চনবর্না নেই। অনমনীয় দুর্জয় শৃঙ্গ তখন শ্বেতবর্না। আরও কিছু সময় থেকে ফেরার পথ ধরলাম। সৌমেন দা ফটো তুলবে বলে আমরা গ্রামের ভিতর দিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা ফুলের মত আমাদের ঘিরে ধরছে মাঝে মাঝে।হঠাৎ চোখ চলে গেল দূরের এক গাছে। এই কনকনে শীতেও রক্ত রঙা রডোডেনড্রন ফুটে আছে। রবি ঠাকুরের 'শেষের কবিতা'র কিছু লাইন মনে পড়ে গেল -
"পথের বাঁধন"
--- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থি।
প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে অরুনকিরণে তুচ্ছ
উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ
নাই আমাদের সঞ্চিত ধনরত্ন
নাই রে ঘরের লালনললিত যত্ন।
পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়
বন্ধন তারে করি না খাঁচায়--
ডানা মেলে দেওয়া মুক্তিপ্রিয়ের কূজনে দুজনে তৃপ্ত ।
আমরা চকিত অভাবনীয়ের ক্বচিৎ কিরণে দৃপ্ত।
ব্রেকফাস্ট করতে করতে ঠিক করলাম ছোট্ট একটা সাইড সিইং করে নেব। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। প্রসাং জী কে বলতেই গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেল। টাটা সুমো। ঘোরাবে - টুকরে, মিরিক, জোড়পোখরি, সীমানা, পশুপতি মার্কেট। সব মিলিয়ে দু হাজার। ঝটপট রেডি হয়ে উঠে পড়লাম গাড়ি তে।
আজ কিন্তু আকাশ একেবারে পরিষ্কার। গলানো সোনার মতো রোদের কম্বল গায়ে দিয়েছে লেপচাজগৎ। তা বলে ঠান্ডার কিন্তু কমতি নেই। পাহাড়ী রাস্তা ধরে দুপাশের সবুজ চা বাগানের মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। হঠাৎ দেখি রাস্তা আলো করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েক টা চেরী গাছ। হালকা গোলাপী রঙের ফুল ঢেকে গেছে। ঠান্ডা হাওয়ার সাথে তার পাপড়ি গুলো উড়ে যাচ্ছে। এরকম দৃশ্য দেখে গাড়ি না থামিয়ে পারা যায় না। নামতেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাসের সাথে চেরী ব্লসমের পাপড়ি এসে আমাদের গাল ছুঁয়ে দিল। দূরের গাছ গুলো থেকে ঝাঁক বাধা মৌমাছির গুন গুন, নিস্তব্ধ পরিবেশে যেন অজানা ভাষায় মন্ত্র উচ্চারণের মতো শোনায়। চোখ আর প্রান ভরে দেখে নিয়ে চললাম টুকরের দিকে। অল্প একটু সময়ের মধ্যে এসে গেলাম। আসলে একটা ছোট্ট পার্ক মতো ভ্যালি। একফালি তীর তীরে পাহাড়ী নদীর উপরে ব্রিজ। ব্যাস। সেখানেই একটু ঘুরে ফিরে এবার গাড়ির চাকা ঘুরল মিরিকের দিকে। আমাদের ড্রাইভার জী এমন সুন্দর সুন্দর রোমান্টিক গান বাজাতে শুরু করলেন যে সৌমেন দা তো বলেই ফেলল যে গান গুলো কপি করে নেবে। দেখতে দেখতে মিরিক। পাহাড় আর সবুজ গাছ পালা ঘেরা মাঝারি সাইজের একটা লেক, অসংখ্য মাছে ভর্তি। মাছের খাবার দেওয়ার জিনিস পত্র ও বিক্রি হচ্ছে। একটু হাঁটা হাঁটি করে সবাই মিলে আনারস আর কমলালেবুর জুস খেয়ে নিলাম। এবার যাব জোড়পোখরি। হঠাৎ দেখি ঝকঝকে রোদ আস্তে আস্তে কুয়াশার লেপের তলায় ঢুকেছে। এই জোড়পোখরি যাওয়ার রাস্তা টা আমার বেশ পছন্দ হলো। সেই মিস্টিরিয়াস কুয়াশা ঘেরা পাইন বন,গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়ালেই মেঘ, ঝিমঝিমে বন্য মাতাল করা সোঁদা গন্ধ, বনতুলসীর রঙিন ফুলের পাথরের খাঁজ থেকে উঁকি ঝুঁকি যেন রূপকথার দেশে নিয়ে যায়। জোড়পোখরি দেখে চললাম পশুপতি মার্কেটের দিকে। নেপালের বর্ডারে মার্কেট বসেছে। আমাদের গাড়ি কিন্তু মার্কেট পর্যন্ত গেল না। বর্ডারে পরিচয়পত্র দেখিয়ে নেপালের গাড়ি নিয়ে দুই - তিন মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম মার্কেটে। কিছু দোকান পাট আছে। তবে সে রকম কিছু না। আর দেখলাম প্রচুর ব্র্যান্ডেড জিনিস অনেক কম দামে বিক্রি হচ্ছে, তবে তা আসল না নকল বুঝতে পারলাম না। তাই কেনাকাটা কিছু করলাম না। এবার আমাদের গন্তব্য সীমানা। কুয়াশা ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠান্ডা। মালিনীর আবার বেশ খিদে পেয়ে গেছে। সীমানা জায়গা টাও আসলে নেপালের সীমান্ত। গাড়ি একটু আগে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরাও হাঁটি হাঁটি পা পা করে নেপালে ঢুকে গেলাম। শুনলাম জায়গা টা নাকি আসলে ভিউ পয়েন্ট। ওখান থেকে নেপালের বেশ কিছুটা দেখা যায়। তবে এমন ঘন কুয়াশাতে ঢেকে গেছে যে সে দেখার সুযোগ আর হলো না। আর খাবারের দোকান দেখে মালিনীর খিদে তখন হাই জাম্প লং জাম্প দিচ্ছে। ওয়াই ওয়াই আর চিকেন মোমো অর্ডার করা হলো। খেয়ে নিয়ে আবার গাড়ি তে। এবার সোজা লেপচাজগৎ হোম স্টে।
পৌঁছে শুনি লোডশেডিং। স্নান করার জন্য গরম জল পাওয়া যাবে না। কখন আসবে পাওয়ার তাও বলা যাবে না। আর যা কাঁপানো ঠান্ডা তাতে আর স্নান করার ইচ্ছেও কারোর নেই। কোনও রকমে হাত মুখ ধুয়ে সোজা লাঞ্চ করতে বসে গেলাম। গরম ভাত ডাল চিকেন যেন অমৃত। বাইরে কিন্তু কুয়াশায় আধো অন্ধকার। খেয়ে দেয়ে আর ওই বরফ বিছানায় যেতে ইচ্ছে করল না। এক ঘরে ঢুকে সবাই গাদা গাদি হয়ে বসে গল্প শুরু করলাম। খানিক পরেই ঝুপ করে ঘন অন্ধকার নেমে এল। আজ আমাদের জন্যে আবার সন্ধ্যে বেলায় ছাঁদে ক্যাম্পফায়ার আর চিকেন রোস্টের ব্যবস্থা হয়েছে। খানিক পরেই সে ব্যবস্থা করে প্রসাং জী আমাদের ডাকলেন। ছাদে গিয়ে দেখি আকাশে পরিষ্কার। গোল থালার মতো সাদা চাঁদের স্নিগ্ধ আলো চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। চাঁদের আলো আর কুয়াশা মাখামাখি হয়ে যেন বহু যুগ আগের এক আদিম জগতের ইন্দ্রজাল তৈরী করেছে। দূরের পাহাড় গুলো কে মনে হচ্ছে যেন কোন যাদুকরের তৈরী যাদুপুরী। ঠান্ডা হাওয়ায় দূরের পাইন বন থেকে পাতার ঝমঝম শব্দ যেন কোন অশরীরীর অব্যক্ত আওয়াজ। আগুনে মাঝে মাঝে কাঁচা কাঠ ফাটার আওয়াজ আর চিকেন রোস্টের গন্ধ সব মিলিয়ে এক আধা ভৌতিক পরিবেশ। কারেন্ট আসার কোন নাম গন্ধ কিন্তু নেই।।
আগুনের পাশে আমরা গোল হয়ে জমিয়ে বসলাম। আগুনের তাপ একটু একটু করে আমাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। হঠাৎ শুনি কে গান করছে -
'গুমনাম হ্যায় কোই। বদনাম হ্যায় কোই'।
এই পরিবেশে এরকম গান শুনে পিলে চমকে ওঠাই স্বাভাবিক। তারপর খেয়াল করি আমাদের মধ্যে দিবাকর নেই তো। নিশ্চয়ই ওর কান্ড। ঠিক তাই। দেখি ছাদের পিছনে অন্ধকারে গিয়ে ওই ওসব ভয় পাওয়ানোর ফন্দি আঁটছে। মালিনী এমনিতেই একটু ভিতু তার উপরে দিবাকরের এরকম কান্ড দেখে বেজায় রেগে গেছে। কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। দিবাকর এবার বৌ এর রাগ ভাঙাতে গান ধরলো
'হয় তো তোমারই জন্য হয়েছি প্রেমে যে বন্য'। আমরাও সবাই হৈ হৈ করে গলা মেলালাম। আমাদের গানের আসর জমে উঠল। ঐন্দ্রিলা দি ধরল- 'আমার চোখে তো সকলই শোভন সকলই নবীন সকলই বিমল। সুনীল আকাশ শ্যামল কানন, বিষাদ জোছনা কুসুম কোমল'। সত্যিই তাই এই পরিবেশে কোন গ্লানি কোন দুঃখ আমাদের স্পর্শ করতে পারে না। দেখতে দেখতে রাত বাড়ছে। ঠান্ডা ও বাড়ছে। আগুন একটু কমলেই ঠান্ডা হাওয়া দাঁত নোখ বসিয়ে দিচ্ছে। দেখতে দেখতে আমাদের জ্বালানি কাঠ ও শেষ হয়ে এল। দিবাকর আবার ভুতুড়ে গান শুরু করেছে। সুদীপ ও তার সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে। মালিনী এবার রেগে গেলে খন্ড যুদ্ধ বেঁধে যাবে। ওদের ঠান্ডা করার জন্য আজকের রাতের মতো শেষ গান টা আমিই ধরলাম।
'অসদো মা সদ্গময়ঃ । তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ ।
ওম মৃত্যর্মা অমৃতমঃ গময়ঃ । শান্তি শান্তি ওম
শান্তি ওম, শান্তি ওম, শান্তি ওম, হরি ওম… তদসদ ।।
দেখো আলোয় আলো আকাশ
দেখো আকাশ তারায় ভরা
দেখো যাওয়ার পথের পাশে
ছোটে হাওয়া পাগলপারা ।
এত আনন্দ আয়োজন
সবই বৃথা আমায় ছাড়া ।
ভরে থাকুক আমার মুঠো
দুই চোখে থাকুক ধারা
এল সময় রাজার মতন
হল কাজের হিসেব সারা
বলে আয়’রে ছুটে আয়’রে ত্বরা
হে’থা নাইকো মৃত্যু নাইকো জরা ।'
এই গান টা যেন সবার জীবনেরই কথা। দেখি সবার চোখ ভিজে গেছে। নাহ। আর দেরি না। কাল আবার সকাল সকাল বেরিয়ে সত্যজিৎ রায় ফেলুদার আর আমার সেই রঙীন দার্জিলিং যাওয়ার পালা। ঝটপট ডিনার সেরে সোজা কম্বলের মধ্যে। হঠাৎ মন টা খারাপ হয়ে গেল। এই এত সুন্দর জায়গা ছেড়ে আর কিছু ক্ষণের মধ্যে চলে যেতে হবে! এই পাহাড় ঘেরা পাইন কুয়াশার অজানা ভাষায় বলা কত কথা শোনা যে বাকি থেকে গেল। আধো ঘুমের মধ্যে বাইরের শোঁ শোঁ বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে সোজা গাড়ি তে। গন্তব্য দার্জিলিং। টাটা সুমো গাড়ি। ভাড়া সাতশো টাকা। প্রসাং জী খুব করে বললেন আবার আসতে। ওনার আতিথেয়তায় আমরা কিন্তু সত্যিই খুব খুশি। গাড়ি চলল ফেরার রাস্তা ধরে। ঘুম হয়ে দার্জিলিং। আড্ডা গল্পে রাস্তা টুকু দেখতে দেখতে কেটে গেল।
পৌঁছলাম দার্জিলিং। ম্যালের পাশেই আমাদের হোটেল। হেঁটে 2-3 মিনিট। ঠিক হলো লাগেজ রেখে আমরা কেভেনটার্সেই দুপুরের খাওয়া টা সেরে নেব। হোটেল টা কিন্তু এক কথায় চমৎকার। দারুণ রুম, রুম হিটার, গিজার, ঝকঝকে বাথরুম, ইলেকট্রিক কেটলি, ফ্লাস্ক,টি ব্যগ, সুগার, মিল্ক পাউডার সব ঘরে মজুত। আর সব থেকে দারুণ- বড় বড় কাঁচের জানালার পর্দা সকালেই দার্জিলিঙের দারুণ ভিউ। হাত মুখ ধুয়ে চললাম কেভেনটার্সের দিকে। সেই প্রথম দার্জিলিং এ বাবা মার সাথে এসে কেভেনটার্সের হট চকলেটে প্রথম চুমুক এর স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। এরপর তো বড় হয়ে যতবার ফেলুদা পড়েছি ততবারই কেভেনটার্সের নাম পড়ে হট চকলেটের লোভের ঢোক গিলেছি। আর আজ তো যত এগোচ্ছি তত খিদে পাচ্ছে। মালিনী আর ঐন্দ্রিলা দি ম্যালের দোকান গুলো দেখে শপিং এর প্ল্যান করছে। কিন্তু আমার একটাই লক্ষ্য আপাতত - কেভেনটার্স। টুক করে পৌঁছে সোজা রুফ টপে। মেনু আমার মুখস্থ। অর্ডার দিয়ে দিলাম - আমার আর সুদীপ এর পর্ক প্ল্যাটার, বাকি দের চিকেন। একটা প্ল্যাটারে দুজনের পেট ভরে বেশি হয়। মালিনী আর আমি হট চকোলেট, দিবাকর ব্ল্যাক কফি, সুদীপ আর ঐন্দ্রিলা দি দার্জিলিং টী, সৌমেন দা ক্যাপাচিনো। ব্যস অর্ডার কমপ্লিট। এবার ভালো করে রুফ টপ টা খেয়াল করে দেখি প্রায় সেই এক ই রকম আছে। ওই কোনের টেবিল টায় আমি আর বাবা সন্ধ্যে বেলা এসে হট চকলেট খেয়েছিলাম। বাবাই তো আমাকে প্রথম কেভেনটার্স চেনায়। আজ থেকে প্রায় সে সতেরো বছর আগের কথা। তাও যেন মনে হয় এই তো সেদিন - মায়ের জোর করে পরানো হনুমান টুপি পরে বাবার পাশে বসে হট চকলেট খাচ্ছি। ভাবতে ভাবতে আমাদের প্লেট হাজির। এক মুহুর্ত আর দেরি না। যা সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে সবাই হুড় মুড়িয়ে খেতে শুরু করলাম। আহা এ স্বাদ ভোলার নয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে প্লেট পরিষ্কার। এত কিছু হজম করাও কষ্টকর। বেলা ও ভালো হয়েছে। এবার একটু স্নান করে বিশ্রাম দরকার। লেপচাজগৎ এর ওই ভয়ানক ঠান্ডা কাটিয়ে এসে দার্জিলিঙের ঠান্ডা বেশ আরামদায়ক লাগছে। কেভেনটার্স থেকেই বাড়ির সবার জন্য দার্জিলিং টী নিয়ে নিলাম। ঠিক হলো বিকেলে একটু ম্যালের দিকে এসে শপিং করব। হোটেলে পৌঁছে ভালো করে গরম জলে স্নান করে রুম হিটার চালিয়ে নরম লেপের তলায়। শুতেই আরামে চোখ বুজে এল।
বিকেলে বেরিয়ে কিন্তু হতাশ হলাম। রবিবার যে বেশীরভাগ সব দোকান ই বন্ধ থাকে। অগত্যা কি আর করা - ম্যালের বেঞ্চ গুলো তেই বসে আড্ডা জমালাম। এখনও সেই ম্যালে ঘোড়া নিয়ে সওয়ারি রা দাঁড়িয়ে থাকে, বাচ্চাদের ছুটো ছুটি, রং বেরং এর পোশাকের ভিড়। কিছু জিনিস মনে হয় কখনও পাল্টায় না। সেই একই রকম রঙিন দার্জিলিং একটুও ফ্যাকাসে হয় নি। হাঁটতে হাঁটতে একটু গ্লেনারিস বেকারির দিকে গিয়ে কুকিস আর অ্যাপল পাই এর সদ্ব্যবহার করে ফেললাম। আর রাতে ডিনারের জন্যে মিক্সড চাউমিন নিয়ে নিলাম। ঘরে ফিরে জমাটি আড্ডা। কিন্তু কাল ই যে ফিরতে হবে। ঝপ করে যেন দিন শেষ হয়ে গেল। ঠিক হল আমরা সকালে বেরিয়ে ম্যালে ঘুরে যা শপিং করার করে সোজা এন জে পি চলে যাব। ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আমার ছোটবেলার উল্টানো আকাশ। মা কে বলা আমার সেই ছোট্ট ছড়ার লাইন গুলো বড্ড মনে পড়ছে -
'দার্জিলিং দার্জিলিং কুয়াশা ঘেরা ঝাপসা দিন '। সেই ছবির পাতা থেকে উঠে আসা আমার প্রথম দেখা কু ঝিক ঝিক টয়ট্রেন।ম্যালে ঘোড়ার পিঠে একা একা চাপা, টাইগার হিলের প্রথম আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা, বাতাসিয়া লুপ। কোন কিছুই যেন এখানে পুরনো হয় না। আষ্টেপৃষ্ঠে সযত্নে বাঁধিয়ে রাখে স্মৃতি গুলো কে। দার্জিলিং নস্টালজিক।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি চারদিকে রোদে ঝলমল করছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্টের জন্য গেলাম। buffet breakfast. হরেক রকম খাবার সাজানো। যার যা পছন্দ। মালিনী কিন্তু কেভেনটার্স কেভেনটার্স করতে লাগল। ব্রেকফাস্টে সেরে স্নান করে লাগেজ মোটামুটি গুছিয়ে নিলাম। দুপুর বারোটা আমাদের চেক আউট টাইম। এবার একটু ম্যাল আর শপিং পর্ব। দরদাম করে বেশ কিছু শপিং সবাই করে ফেললাম। কতক্ষণ যে টাইম কাটলো খেয়াল ই নেই। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই। তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে একটা গাড়ি ও ঠিক করে নেওয়া হলো এন জি পি যাওয়ার। পাশেই একটা বাঙালি হোটেলে পেট পুরে খেয়ে নিলাম। আর কি!! এবার ফেরার পালা। গাড়ির মাথায় লাগেজ আর গাড়ির ভিতরে আমরা। চললাম এন জি পির দিকে। পেট পুরে ভাত খেয়ে গাড়িতে কিছু ক্ষণ ঘুমিয়েই পড়লাম। ঘুমের ভাঙলো যখন দেখি দুপাশে চা বাগান। সময় কতো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল। কাল থেকে আবার তো সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুট ছুট আর ছুট। তবে ফুসফুস ভরে ছোটার জন্যে অক্সিজেন নিয়ে নিয়েছি বেশ কিছু দিনের জন্য। এই দিয়েই আপাতত কাজ চালাতে হবে। গাড়ি তে আজ সবাই ই বেশ চুপ চাপ। সবার ই মন খারাপ লাগছে। একটু মন ভালো করার জন্য আমি ফোনেই গান চালালাম -
খাদের ধারের রেলিঙটা
সেই দুষ্টু ডোডো সিড়িংটা
আমার শৈশবের দার্জিলিংটা
জানলার কাছে টপকে পেয়ে
ছবি এঁকেছি নিঃশ্বাসে
পাহাড় আঁকা কত সোজা
হারিয়ে গেছে সেই ড্রয়িং খাতা
চারটা ঠোঁটের ভালাবাসা
খুদে চোখে কত আশা
যখন তখন সাদা কুয়াশা
খাদে নেমে প্রথম সিগারেট
সেখান থেকে স্কুলের গেট
দশ মিনিট দৌড়ে নইলে লেট
রোল কল হয়ে গেছে এবার বেত
ঘুম সোনাদা ঘুম পেরিয়ে
একা বেকা রাস্তা ধরে
যখন তখন পৌছে যাওয়া যায়'
আবার যখন তখন দার্জিলিং নিশ্চয়ই আসবো।
দেখতে দেখতে এন জি পি। লাগেজ নিয়ে প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন টাইমের তিন ঘণ্টা আগেই চলে এসেছি। বসে বসে গল্প ছাড়া কাজ নেই আর। সুদীপ ই ওর জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময় হোস্টেলে লাইফের গল্প বলে আমাদের সবাই কে হাসাতে লাগল, টাইম ও কিন্তু ভালোই এগোচ্ছে। রাতে ডিনারের জন্য IRCTC Food Plaza থেকে বিরিয়ানি নিয়ে নিলাম। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেন ও দিয়ে দিল। সবার কোচ আলাদা। অতএব বলা হল কাল শিয়ালদহ নেমে একেবারে দেখা হবে। বিরিয়ানি খেয়ে আমার কিন্তু এক ঘুমে রাত কাবার।
সকালে শিয়ালদহ পৌঁছতেই কিন্তু মন টা বেজায় খারাপ হয়ে গেল। আবার সেই জ্যাম, ধোঁয়া, লাইন, চিৎকার,,, ধুস আর ভালো লাগে না। আমার তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা। বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে আছি। দুম করে সুদীপ বললো তাড়াতাড়ি হাঁটো। সিনেমা টা যে মিস করব। এখন আবার কিসের সিনেমা? মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেল? দেখি পদ্মাবত সিনেমার টিকিট কেটে তিনি হাসছেন। সবাই কে টা টা করে আমরাও আমাদের পথ ধরলাম। বাড়ি পৌঁছেই যে আবার বেরোতে হবে। কানে এল কোথাও একটা গান বাজছে -
শহর জুড়ে যেন প্রেমের মরসুম
আলোতে মাখামাখি আমার এ গ্রীনরুম
কখনও নেমে আসে অচেনা প্যারাসুট
তোমাকে ভালোবেসে আমার এ চিরকুট
শহর জুড়ে যেন প্রেমের মরসুম
আলোতে মাখামাখি আমার এ গ্রীনরুম
কখনও নেমে আসে অচেনা প্যারাসুট
তোমাকে ভালোবেসে আমার এ চিরকুট
কলকাতা, তুমিও হেটে দেখো
কলকাতা, তুমিও ভেবে দেখো
কলকাতা, তুমিও হেটে দেখো
কলকাতা, তুমিও ভেবে দেখো
যাবে কি না যাবে আমার সাথে।
এই গানের ই কয়েক টা লাইন তাড়াতাড়ি whatsapp করে সুদীপ কে পাঠালাম -
তবেই তোমার কথা কলকাতা কলকাতা
সব কিছু মেনে নিতে পারি
কেন এ অসম্ভবের, ডেকে আনো আমাকে
ছুয়ে থাকে হাতটাকে, কবিতার ছাদটাকে।
লেপচাজগৎ হোম স্টে - কাঞ্চনকন্যা হোম স্টে(+919564555618, +919593565309)
দার্জিলিং - central nirvana resort
সবশেষে অশেষ ধন্যবাদ Sudip Dibakar @malini @Aindrila di আর @soumen Da কে। তোমরা না থাকলে বেড়ানো টা এত মজার এত আনন্দের হতো না।
ছবি গুলোর বেশিরভাগ সৌমেন দা তুলেছে।